আচ্ছা বলুন তো ৯৪ র ফুটবল বিশ্বকাপে নক্আউট রাউন্ডে আর্জেন্টিনা কার কাছে হেরে বিদায় নেয়? ৯৮ র বিশ্বকাপে কে বা কারা হ্যাট্রিক করেছিলেন ? ২০০২ বিশ্বকাপে ৮ কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট দেশ কারা ছিল ? ২০০৬ বিশ্বকাপে কতগুলো ম্যাচ টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হয়েছিল ? ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনাল কত তারিখে হয়েছিল ? আপনারা নিশ্চিত ভাবছেন গুগল্ বাবার দৌলতে এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া কি এমন আর ব্যাপার । এবার নিজেদেরকে টাইম মেশিনে ২০\২২ বছর পিছিয়ে নিয়ে যান । মনে মনে এমন একটা দুনিয়ার কল্পনা করুন যেখানে ইন্টারনেট তো কোন ছাড় , কম্পিউটার বস্তুটি কি,
খায় না মাথায় দেয় তার ধারণা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহু আলোকবর্ষ দূরে থাকা নক্ষত্রের মতো ছিল । কল্পনা করুন এমন একটা যুগের যখন মানুষের কাছে দৈনন্দিন তথ্য সংগ্রহের প্রধানতম উপায় ছিল সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন । নিজের পছন্দমতো যেকোন টপিকের উপর জানতে গুগলে সেই টপিকটা টাইপ করে হাজার হাজার সাইট থেকে তার ব্যাপারে জেনে জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করব
– এ আমার ছোটবেলায় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই অকল্পনীয় ছিল ।
তো আজ থেকে ঠিক ২৪ বছর আগে এরকমই এক তথ্যপ্রযুক্তি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটবিহীন দুনিয়ায় আমার খুবই প্রিয় একজন পদার্পন করে । না সে কোন রক্তমাংসের মানব বা মানবী নয়। সে হল একটি লম্বা আয়তকার বাঁধানো খাতা । ভালোভাবে বলতে গেলে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্ট্যাট বুক । ১৯৯৪ সালে U.S.A. তে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সময় থেকে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত আমি সে খাতায় ৬ টি বিশ্বকাপের (১৯৯৪,১৯৯৮,২০০২,২০০৬,২০১০,২০১৪
) সমস্ত ম্যাচের ফলাফল লিপিবদ্ধ করে রেখেছি । এছাড়াও সেখানে পাওয়া যাবে ৬ টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ (১৯৯৬,২০০০,২০০৪,২০০৮,২০১২,২০১৬
) ও ১৯৯৯ কোপা আমেরিকার সমস্ত ম্যাচের ফলাফল ।
তখন আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র । ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবার বিল ক্লিন্টনের দেশে বসল ফুটবল মহাযুদ্ধের জমকালো আসর । বিশ্বকাপ শুরুর দিন তিনেক আগে কিভাবে যেন আমার হাতে এল ব্যাঙ্ক কর্মচারী আমার বাবার অফিসের একটা বাঁধানো খাতা । খাতাটা পেয়ে হঠাৎ মাথায়
একটা আইডিয়া খেলে গেল । ভাবলাম বিশ্বকাপের সমস্ত খেলার ফলাফল যদি পরপর তারিখ
অনুযায়ী খাতায় টুকে রাখি তাহলে তা একটা আদর্শ স্ট্যাট বুকের কাজ করবে । যেমন ভাবা তেমন কাজ । খাতার প্রথম পাতায় মাকে
দিয়ে স্বর্গীয় সুন্দর হস্তাক্ষরে গোটা গোটা করে লেখালাম “বিশ্বকাপ ফুটবল 1994,
U.S.A’’ । ১৭ জুন জার্মানি বনাম বলিভিয়া ম্যাচ
দিয়ে শুরু হল ১৯৯৪ বিশ্বকাপ । সেই ম্যাচে জার্মানি ১-০ গোলে বলিভিয়াকে হারালো । আমার স্ট্যাট বুকে প্রথম
গোলদাতা হিসাবে জায়গা করে নিলেন জার্মানির য়ুরগেন ক্লিন্সম্যান ।
তারপর বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে আমার বাঁধানো খাতাটি গত চব্বিশ বছরে গোলদাতাদের এক মহাসাগরে পরিণত হয়েছে । ক্লিন্সম্যান থেকে শুরু করে মারাদোনা, বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া, রোমারিও, বেবেতো, রবার্তো বাজ্জিও, দিনো বাজ্জিও, হাজি, দুমিত্রেস্কু,এস্কোবার, স্তোইচকভ, লেচকভ,আমোকাচি,আমুনিকে,ফিনিদি জর্জ, এম্বে, ওমাম বিয়িক, ব্রেগি, উইনাল্ডা, চ্যাপুইসাট, সঈদ উইরান, ব্রোলিন, ডালিন, লারসন,সালাস,জামোরানো,সুকের,বোবান,ভিয়েরি,ইনজাঘি,ওর্তেগা,হিয়েরো,রাউল,মরিয়েন্তেস,মেনদিয়েতা,রোনাল্ডো,রিভাল্ডো,রোনাল্ডিনহো,বার্গক্যাম্প,কোকু,ক্লুইভার্ট,ডি বোয়ের ব্রাদার্স,শিয়েরার,ওয়েন,বেকহ্যাম,ল্যাম্পার্ড,জেরার্ড,লাউড্রপ ব্রাদার্স, ওদেপোজু, লাওয়েল,ওলিশে,জিদান,অঁরি,দুগারি,ব্লঁ,পেতিত,উইলটোর্ড,দিয়রকায়েফ,বালাক,নয়েভিল,বিয়েরহফ,ক্লোজে,সোয়াইনস্টাইগার,লাম্, ফিগো,মানিশ্, ডেকো,পস্তিগা,নুনো গোমস,পাউলেটা,রোনাল্ডো (ছোট), রবেন,স্নাইডার,নিস্টেলরুই, ভ্যান পার্সি, জেনডেন,আন্ জাং হোয়ান, হং মিয়ং বো, সিও জিন হো, ওয়ানচোপ, ফোরলান,সুয়ারেজ,কাভানি,রেকোবা,রাপাইচ,ওলিচ,মড্রিচ,ম্যান্ডজুকিচ,পেরিসিচ,বালোতেল্লি,আলবার্তিনি,ইভানি,দেল পিয়েরো, পিরলো,গ্রসো, মাতারাৎজি,জাভি,ভিয়া,টোরেস,ইনিয়েস্তা,সিলভা,এন্ডো,হন্ডা,তামাদা,রেকডাল,রমেডাল,টোমাসন,সাবালালা,পাপা বউবা দিওপ, কামারা, বাবাঙ্গিডা,আয়ালা,ক্রেসপো,মেসি,ডি মারিয়া, পালারমো, হিগুয়াইন,শাকিরি,জাকা,মার্কুয়েজ,হারনানডেজ,মুলার,ওজিল,শ্যুরলে,গ্যোৎজে,খেদিরা,ড্রাক্সলার,টনি ক্রজ, নেইমার,মার্সেলো,থিয়াগো সিলভা, লুকাকু,ডি ব্রুয়েন, উইলমোটস্,পুওল,হামেস রডরিগেজ, কুয়াদ্রাদো, গোডিন, চেরিশেভ, কোকোরিন, পাভলুচেঙ্গ্কো, টরবিনস্কি,আর্শাভিন,মাতুইদি, মালুদা, গ্রিজম্যান, পায়েত, জিঁরু, এডের, নানি, পেপে, পেল্লে, জিয়াচ্চেরিনি, ডস্ স্যান্টোস, ম্যাকব্রাইড, ডোনোভান, ব্র্যাডলি,সালাই, স্টিবের, হুলাহান, সিগুর্ডসন, ফেলাইনি, মার্টেন্স, গোল মহাম্মদি, বেনিতেজ, স্যাঞ্চেজ, কুয়েভাস, গামারা, আসামোয়া, মুন্তারি, লেওয়ানদস্কি, ভার্গাস, পিকে, বেঞ্জিমা,ওরিগি, মাইকন, এলানো, সুকুর,মানসিজ,পোগবা,আদ্রিয়ানো,কাকা,রবিনহো,জ্যানেত্তি ……. উফ্ ছেড়ে দে মা তোর পায়ে পড়ি । বলতে বলতে হাফিয়ে উঠেছি । খুব কম করে প্রায় ১০০০ গোলদাতার নাম আমার খাতায় বাংলা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা আছে । একেবারে যাকে বলে ‘শক হুণদল পাঠান মোগল একদেহে হল লীন’ ।
স্ট্যাট বুকটায় চোখ বোলালে যে কত সোনালী স্মৃতি মাথায় ভিড় করে । মনে পড়ে যায় ২৭ শে জুন ১৯৯৮ সালের কথা । ঐদিন আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হয়েছিল । রাতের বেলায় বিশ্বকাপের দু দুটো ম্যাচ ছিল ঐ একই দিনে । প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালি ও নরওয়ে আর ব্রাজিল ও চিলি । মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হবে, বাড়ীশুদ্ধু লোকের টেনশন । অথচ আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । আমি স্ট্যাট বুকে খেলার ফলাফল নোট করতে ব্যস্ত । ২৭.০৬.৯৮ তারিখের পাশে M.R.O.
কথাটা লিখে রাখা আছে যার পুরো কথা Madhyamik
Result Out। আবার ১৮ জুন ২০০২ তারিখটাও স্মরণে পড়ে । ঐদিন আমার পার্ট টু অনার্স পরীক্ষার শেষ দিন ছিল । বিকেলবেলা ছিল ইতালি বনাম দক্ষিন কোরিয়ার প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ । পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে ফিরে দেখি ম্যাচ শুরু হয়ে গিয়ে ইতালি ভিয়েরির গোলে এগিয়ে গেছে । তারপর ঘটল ২০০২ বিশ্বকাপের সেরা সেই অঘটন । দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ২-১ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল ইতালি । ২১ শে জুন ১৯৯৪ তারিখটাও আমার কাছে খুবই স্পেশাল । ঐদিনই আমি প্রথম প্রবাদপ্রতিম আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার বাতিস্তুতার খেলা দেখি । গ্রীসের বিরুদ্ধে বাতিস্তুতা হ্যাট্রিক করেন । মারাদোনার শেষ বিশ্বকাপ গোল ও ঐ একই ম্যাচে । আর্জেন্টিনার অসাধারণ টাচ প্লের জন্য ম্যাচটি দীর্ঘদিন স্মৃতিতে থাকবে ।
আমার কাছে বিশ্বকাপ ফুটবল মানে শুধুই রাত জেগে খেলা দেখা নয় । বিভিন্ন কাগজ ঘাটাঘাটি করা, বিশ্বকাপের article খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া, অ্যালবাম তৈরী করা, স্ট্যাট বুকে ফলাফল টুকে রাখা ইত্যাদি বহুবিধ কাজ ফুটবলের প্রতি প্যাশন থেকে করি । আমার স্ট্যাট বুকে বিশ্বকাপজয়ী ও ইউরোজয়ী দেশ হিসাবে অনেক দেশের নামই আছে । কিন্তু আমার প্রিয় আর্জেন্টিনার নাম বিশ্বকাপ জয়ী দেশ হিসাবে লিখে রাখার সুযোগ এখনো আসেনি । কেউ আমায় জিজ্ঞেস করতেই পারেন তোমার দেখা সেরা পাঁচটা ম্যাচ স্ট্যাটবুক থেকে বেছে নাও । কয়েকশো ম্যাচের মধ্য থেকে ৫টা ম্যাচ বেছে নেওয়া বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার মতোই কঠিন ব্যাপার । তাও কোমরে গামছা বেধে চেষ্টা করছি –
১. বিশ্বকাপ ২০০২ কোয়ার্টার ফাইনাল –
ব্রাজিল – 2
( রোনাল্ডিনহো,রিভাল্ডো )
ইংল্যান্ড – ১ ( ওয়েন )
২. বিশ্বকাপ ১৯৯৮ গ্রুপ লীগ –
নাইজিরিয়া – ৩ ( আদেপোজু, জুবিজারেতা og,ওলিশে )
স্পেন – ২ ( হিয়েরো, রাউল )
৩. বিশ্বকাপ ১৯৯৮ গ্রুপ লীগ –
জার্মানি – ২ ( মিহাইলোভিচ og,
বিয়েরহফ )
যুগোস্লাভিয়া – ২ ( মিজাটোভিচ, স্তোইকোভিচ )
৪. বিশ্বকাপ ২০০৬ গ্রুপ লীগ –
আর্জেন্টিনা – ৬ ( রডরিগেজ -২,ক্যাম্বিয়াসো,ক্রেসপো,তেভেজ, মেসি )
সার্বিয়া মন্টিনেগ্রো – ০
৫. ইউরো ২০০০ গ্রুপ লীগ –
স্পেন – ৪ ( আলফনসো – ২, মুনিতিস, মেনদিয়েতা )
যুগোস্লাভিয়া – ৩ ( মিলোসেভিচ, গোভেদারিকা, কমলজেনোভিচ )
No comments:
Post a Comment