ডন
ক্রেসেঞ্জোর সাথে
কথা বলা
খুবই কঠিন
ছিল,
কারন সে
কানে একদমই
শুনতে পেত
না।
একটা কাগজের
টুকরোতে বক্তব্যটুকু
না লিখে
দিলে তার
সঙ্গে কথাবার্তাই
শুরু করা
যেত না। লোকেদের
এটাই ধরে
নিতে হতো
যে ডন
আমাদের এই শব্দের
দুনিয়ায় বসবাসকারীদেরই একজন।
একবার
আমি ডনকে
জিজ্ঞাসা করেছিলাম
যে ক্রিষ্টমাস
কেমন কাটছে।ডন সে
সময় হোটেলের
প্রবেশপথের সামনে একটা
চেয়ারে বসেছিল। তখন
ঘড়িতে ছটা
বাজে।
চারপাশ নিস্তব্ধ। আমি
অন্য একটা
চেয়ারে বসে
তাকে পুনরায়
প্রশ্নটা করলাম। ডন
তার হাতদুটো
কানের পাশে
রেখে বললো,
“না’’। এরপর
সে পকেট
থেকে একটা
কাগজ ও
পেন্সিল বের
করে আমায়
দিল।
আমি সেই
কাগজটার উপর ‘ক্রিষ্টমাস’
শব্দটা লিখে
উৎসুকভাবে তার
মুখের দিকে
তাকালাম।
এখন
আমি ক্রিষ্টমাসের
যে গল্পটা
শুরু করবো
সেটা বাস্তবে
ডন ক্রেসেঞ্জোরই
গল্প।
কিন্তু তার
আগে আমার
ডনের সম্বন্ধে
আরও কিছু
কথা জানানো আবশ্যিক। পাঠকদের
এটা জানা
অবশ্যই প্রয়োজন
যে ডন
একসময়
কিরকম গরীব
ছিল আর
বর্তমানে সে
কত বড়লোক। এখন
তার অধীনে
একশোরও বেশী
লোক কাজ
করে।
বিশাল আঙুরের
ক্ষেত আর
সাতটা বাড়ীর
মালিক সে। এই
কানে কালা
লোকটার মুখাবয়ব
আপনাদের কল্পনা
করে নিতে
হবে।
সে মুখে
অমায়িকতার ছাপ
স্পষ্ট ফুটে
ওঠে।
যেভাবে সে
করুণ মুখে
একা একা
হোটেলের আশেপাশে
ঘুরে বেড়াত,
সে দৃশ্য
আপনাদের চোখের
সামনে কল্পনা
করতে হবে। এরপর
এটা আপনাদের
জানা আবশ্যিক
যে সে
খুব আনন্দের
সঙ্গে তার
জীবনের কাহিনী
শোনাত।
গল্প বলার
সময় একদম
না চেঁচিয়ে
নীচু গলায়
কথা বলতো।
আমি
প্রায়ই তার
গল্প শুনতাম। স্বাভাবিকভাবেই
ক্রিষ্টমাসের গল্প
আমার জানা
ছিল।
এ গল্পের
শুরু সে
রাতে, যে
রাতে পাহাড়ে
ধ্বস নেমেছিল। লোকেরা
চেঁচামিচি করতে
লাগলো, “ধ্বস
নেমেছে, হুঁশিয়ার।“ ডনের
তখন মোটে
সাত বছর
বয়স।
পরিবারের সকলে
ডনকে বিছানা
থেকে টেনে
হিঁচড়ে নামিয়ে কোনোমতে
সরু পথ
দিয়ে পালিয়ে
গেল।
এই বিপর্যয়ের
বর্ণনা দিতে
দিতে ডন
তার হাত
দুটো কানের
পাশে তুলে
দেখাত যে
সেই ভয়ানক
রাত ছিল
তার বধিরতার
নিশ্চিত কারন। “আমার
তখন সাত
বছর বয়স
ছিল।
আমি তখন
খুব অসুস্থ
ছিলাম।’’ কানের পাশে হাত
তুলে ডন
বলতো, “যে
মুহূর্তে ধ্বস
নেমে আমাদের
বাড়ী ধুলিসাৎ
করে সমুদ্রে
ফেলে দিলো,
সে সময়
আমরা সকলে
রাতের পোশাক
পরেছিলাম।
শরীরের উপর
পোশাকটাই ছিল
আমাদের একমাত্র
সম্বল।
বাকি আর
কোনোকিছুই অবশিষ্ট
ছিলনা।
এরকম অসহায়
অবস্থায় আত্মীয়দের
কাছে আশ্রয়
জুটেছিল।
এখন যে
জমিতে হোটেলটা
দাঁড়িয়ে আছে,
সেটা পরবর্তীকালে
আত্মীয়রাই আমাদের
দান করেছিল। শীত
আসার আগে
আমার বাবা-মা
সেই জমিতে
একটা বাড়ী
বানিয়েছিলেন।
বাড়ী তৈরীর
কাজটা বাবা
নিজের হাতে
করেছিলেন।
মা বস্তায় ইট ভর্তি
করে তার
কাছে দিয়ে
আসতেন।
মা বেঁটেখাটো
দুর্বল চেহারার
মানুষ ছিলেন। যখন
দেখতেন চারপাশে
কেউ তাকে
লক্ষ্য করছে
না, তখন
সিঁড়ির উপর উনি
একাকী বসে
চোখের জল
ফেলতেন।
বছরের শেষ
দিকে বাড়ী
বানানোর কাজ
সম্পূর্ণ হয়ে
গেছিলো।
আমরা ঘরের
মেঝেতে শুয়ে ঘুমোতাম
আর প্রচণ্ড
ঠাণ্ডায় জমে
যেতাম।’’
“তারপর
ক্রিষ্টমাস এল’’,
আমি তাকে
বললাম ও
কাগজে লেখা
‘ক্রিষ্টমাস’ শব্দটা
দেখালাম।
“হাঁ”, ডন
বলতে লাগলো,
“তারপর ক্রিষ্টমাস
এল।
ওইদিন আমার
মন এত
খারাপ ছিল
যে জীবনে
কোনোদিন তা
আগে কখনো
হয়নি।
আমার বাবা
ছিলেন পেশায়
চিকিৎসক।
কিন্তু কখনো
তিনি রোগীদের
কাছ থেকে
ফীজ নিতেন
না।
যখন তারা
তার কাছে
ফীজের ব্যাপারে
জানতে চাইত
তখন তিনি
তাদের সর্বপ্রথমে
প্রয়োজনীয় ওষুধ
কিনতে ও
তারপর স্যুপের
জন্য মাংস
যোগাড় করতে
উপদেশ দিতেন। বাবা
তার রোগীদের
ভালোভাবেই চিনতেন
এবং জানতেন
তারা খুবই
গরীব।
তিনি তাদের
কখনো টাকা দেওয়ার
জন্য চাপ
দিতে পারতেন
না।
এমনকি যখন
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে
সবকিছু খুইয়ে
বাড়ী বানানোর
জন্য আমাদের
শেষ অর্থসম্বলটুকুও
খরচ করে
ফেলেছিলাম, সে
সময়ও তিনি
রোগীদের কাছ থেকে
একটা টাকাও
নেননি।
একবার অবশ্য
ক্রিষ্টমাসের আগে
সে চেষ্টা
করেছিলেন ।
সেদিন আমরা
উনুনে কাঠের
শেষ খন্ডটুকু
পোড়াচ্ছিলাম।
সন্ধ্যাবেলায় মা
একগাদা সাদা
কাগজের টুকরো
নিয়ে এসে
বাবার সামনে
ধরলেন।
এরপর তিনি
তাকে সেই
কাগজে লেখা অনেকগুলো
নাম পরপর
পড়ে শোনালেন। বাবা
একটা কাগজে
সেই নামগুলো
টুকে প্রত্যেক
নামের পাশে
একজোড়া করে
সংখ্যা লিখলেন। পরক্ষণেই তিনি
সেই কাগজটা
উনুনের আগুনে
ছুড়ে ফেলে
দিলেন।উনুনের আগুনটা খুব
সুন্দরভাবে জ্বলছিল। তা
দেখে আমার
মন খুশিতে
ভরে উঠলো। কিন্তু
মা বাবার
দিকে করুন
ও কঠোর
দৃষ্টিতে তাকালেন।
সুতরাং
ব্যাপারটা এইরকম
দাঁড়ালো যে
ক্রিষ্টমাসের আগের
দিন উনুনে
ফেলার জন্য
আমাদের কোন
কাঠ ছিল
না।
আমাদের না
ছিল পেটে
দেওয়ার জন্য
কোন খাবার,
না ছিল
চার্চে যাবার
উপযুক্ত কোন
পোশাক।
আমি মনে
করি না
যে আমার
বাবা-মা
এ নিয়ে
আদৌ কোন
চিন্তা করতেন। বড়রা
এরকম কঠিন
অবস্হার সম্মুখীন
হলে দৃঢ়
বিশ্বাস রাখেন
যে আবার
একদিন তারা ভালো
দিনের মুখ দেখবেন ও আগের
মতই নিয়মিত
খেতে পড়তে
পাবেন।
কিন্তু একটা
বাচ্চার কাছে
ব্যাপারটা সম্পূর্ণ
আলাদা।
এরকম পরিস্থিতিতে
সে বসে
বসে কেবলই
অলৌকিক কিছু
ঘটার অপেক্ষায়
থাকে।
সেরকম কিছু
না ঘটলে
তার আশা
ভরসা সব
কিছু শেষ
হয়ে যায়।
কথাগুলো
বলার সময়
ডন বাইরে
রাস্তার দিকে
এমনভাবে
তাকিয়েছিল
যেন সেখানে
কোন কিছু
তার দৃষ্টি
আকর্ষন করেছে। আসলে
সে তার
চোখের জল
আমার কাছে
লুকোতে চেষ্টা
করছিল।
কিছুক্ষণ পর
আবার বলতে
শুরু করলো,
“তোমরা বাড়ীতে
যেভাবে ক্রিষ্টমাস
পালন কর,
আমাদের ক্রিষ্টমাস
তার থেকে
সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের
কাছে ক্রিষ্টমাস
একটা শব্দমুখর
পরম আনন্দের
উৎসব।
শিশু খ্রীষ্টের
মূর্তি নিয়ে
এসে সাজানো
হয়।
প্রার্থনা সঙ্গীত
হয়।
শিশুদের চেঁচামিচি
ও ডাকাডাকিতে
ঘর ভরে
ওঠে।
কৃষ্ণসাগরে স্রোতের
সশব্দ আওয়াজ শুনে মনে হয়
যেন সে
আনন্দে কাঁদছে
ও গান
গাইছে।
এটাই আমাদের
ক্রিষ্টমাস।
সারাটা দিন
ক্রিষ্টমাস পালনের
প্রস্তুতি নিতে
নিতেই কেটে
যায়।
প্রত্যেক বাড়ীতে
মাংস রোষ্ট
করা হয়
ও কেক
বানানো হয়।
যতদূর
মনে করতে
পারি আমরা
এভাবেই ক্রিষ্টমাস পালন
করতাম।
কিন্তু যেবছর
পাহাড়ে ধ্বস
নেমে দুর্ঘটনা
ঘটলো, সে
বছর ক্রিষ্টমাসের
দিন আমাদের
বাড়ী ছিল
একদম নিস্তব্ধ। বাড়ীর
ভেতর উনুনে
আগুন জ্বলছিল
না।
বাড়ীর ভেতর
অপেক্ষা বাইরের
উষ্ণতা খানিক
বেশী ছিল
বলে আমি
বাড়ীর বাইরে
বেরিয়ে যতক্ষণ
সম্ভব রাস্তায়
দাঁড়িয়েছিলাম।
আমি সিঁড়ির
উপর বসে
রাস্তার দিকে
তাকিয়ে পথচারীদের
আসাযাওয়া ও
টিমটিম করে
জ্বলতে থাকা
বাতিওয়ালা চলমান
গাড়ীগুলো লক্ষ্য
করছিলাম।
রাস্তায় প্রচুর
মানুষ ছিল। তাদের
মধ্যে ছিল
অনেক কৃষক
যারা তাদের
পরিবার নিয়ে
চার্চে যাচ্ছিল। তাছাড়া
অন্য লোকেরাও
ছিল যাদের
আরও কিছু
জিনিষ যেমন
ডিম, তাজা
মুরগী, মদ
ইত্যাদি বেচবার
ছিল।
আমি বসে
বসে মুরগীর
ডাক ও
বাচ্চাদের মজার
কথাবার্তা শুনছিলাম। রাস্তার
প্রত্যেকটা গাড়ীকে
আমি লক্ষ্য
করছিলাম যতক্ষণ
না তা
আমার দৃষ্টির
আড়ালে চলে
যাচ্ছে।
পরমুহূর্তেই ঘাড়
ঘুরিয়ে আমি
নুতন গাড়ী
দেখতে পেলাম। তারপর
রাস্তাটা আস্তে
আস্তে নিস্তব্ধ
হয়ে গেল। আমি
বুঝতে পারলাম
উৎসব শুরু
হয়ে গেছে। পাথরের
বুকে অবিরাম
আঘাত হেনে
চলা সমুদ্রের
শব্দ ছাড়া
আমি আর
কিছু শুনতে
পেলাম না। প্রচণ্ড
খিদের জ্বালায়
আমার মাংস, মিষ্টি
ও মদ
খেতে প্রাণ
চাইছিল।
কিন্তু সবার
আগে আমি
ক্রিষ্টমাসের আনন্দোৎসবে
মেতে উঠতে
চাইছিলাম।
তারপর
যেন হঠাৎ
করে সবকিছু
অবিশ্বাস্যভাবে বদলে
গেল।
রাস্তায় আর
কারও পায়ের
শব্দ শোনা
গেল না। গাড়ীঘোড়া
চলাফেরা করাও
সম্পূর্ণ থেমে
গেল।
হ্যারিকেনের আলোয়
আমরা দেখতে
পেলাম কে
যেন আমাদের
বাগানে একটা
মালভর্তি বস্তা
ফেলে দিয়ে
গেছে।
রাস্তার ওপর
একটা ভর্তি
ঝুড়িও খুঁজে
পেলাম।
সিঁড়ির নীচে
বসার জায়গায়
প্রচুর কাঠ
ফেলে রাখা
ছিল।
খুব সন্তর্পনে
আমি সিঁড়ি
দিয়ে উপরে
উঠে ডিম,
মাছ ও
মুরগীর রোষ্ট
আবিষ্কার করলাম। পুরোপুরি
অবস্থা স্বাভাবিক
হতে বহু
সময় লেগে
গেল।
ধীরে ধীরে
বুঝতে পারলাম
যে হঠাৎ
করে আমরা
খুব বড়লোক
হয়ে গেছি। সেই
মুহূর্তে আমি
জানতাম না,
যদিও আমার
বাবা-মা
হয়তো জানতেন
যে এটা
আসলে বাবার
রোগীদেরই কাজ। তারা
এইভাবে বাবাকে
আনন্দ দেবে
বলে মনস্থির
করেছিল।
ডিম, মাংস,
উনুনে আগুন
ধরানোর কাঠ
ও যে
জামাটা আমি
পাওয়ামাত্রই শরীরে
পরে নিয়েছিলাম
– সমস্ত কিছুই
আমার কাছে
স্বর্গের দান
বলে মনে
হয়েছিল।
মায়ের নির্দেশে
আমি দৌড়ে
সিঁড়ি দিয়ে
নেমে লম্বা
সরু গলি
দিয়ে বেড়িয়ে
রংবেরংয়ের আলো
ঝলমলে রাস্তার
দিকে ছুটে
গেলাম।
শহরে পৌছানোর
সঙ্গে সঙ্গে
কানে ড্রামের
বাজনা ও
চীৎকার চেঁচামিচির
আওয়াজ ভেসে
এল।
আমি মনের আনন্দে
তারস্বরে চেঁচিয়ে
উঠলাম।
পরক্ষণেই বিশাল
বিশাল ঘণ্টা
জোরে জোরে বাজতে
শুরু করে
দিল।
এই
পর্যন্ত বলে
ডন ক্রেসেঞ্জো
চুপ করলো
ও আপন
মনে হাসতে
লাগল।
ঘণ্টার সেই
জোরালো আওয়াজ
নিশ্চয় তার
কানে বাজছিল,
যে আওয়াজ
সে দীর্ঘদিন
শোনেনি এবং
যা অন্যান্য
সকলের চাইতে
তার কাছে
বেশী তাৎপর্য্যপূর্ণ
ছিল।
আমি তার
কাছ থেকে
কাগজের টুকরোটা
নিজের হাতে
নিলাম ও
বললাম, “ডন,
আপনার নিজের
জীবন নিয়ে
গল্প লেখা
উচিৎ।’’
‘‘হ্যাঁ,
লেখাই উচিৎ।’’ সে
প্রত্যুত্তর দিল। পরমুহূর্তে
সে খাড়া
হয়ে দাঁড়িয়ে
মাথা নাড়তে
নাড়তে বললো,
“অনেক কিছুই
করা বাকি
আছে।’’
তক্ষুনি আমি
বুঝতে পারলাম
ডনের কাছে
তার সমস্ত
নতুন বাড়ী
,
হোটেল ও
অন্যান্য সবকিছু
কতটা অর্থপূর্ণ
। সে
কখনই চাইত
না যে
তার সন্তানরা
তার মতো
খিদেয় কষ্ট
পাক বা
চরম দুর্দশার
মধ্যে ক্রিষ্টমাসের
সন্ধ্যা কাটাক। তার
সন্তানরা তার
মতো নিজের
মাকে বস্তা
ভর্তি ইট
বয়ে নিয়ে
যেতে ও
একাকি বসে
চোখের জল
ফেলতে দেখবে,
এটা ডন
ক্রেসেঞ্জোর কাছে
সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত
ছিল।