Thursday 26 March 2020

করোনা বিপর্যয় ও কিছু জরুরি প্রশ্ন : প্রথম পর্ব

মনে করুন আমি কানাই । মোড়ের মাথায় এক কোণে বসে জুতো সেলাই করি । দৈনিক আমার রোজগার হয় মোটামুটি ৩০০ টাকা অর্থাৎ মাস গেলে মেরেকেটে ৯০০০ টাকা । ওই টাকা দিয়ে আমার বউ বাচ্চা বুড়ো বাপ মাকে নিয়ে সংসার চালাতে হয় । কিম্বা মনে করুন আমি ইলেকট্রিক মিস্তিরি শ্যামল । বাড়ী বাড়ী কাজ করে আমার দৈনিক রোজগার হয় ৫০০ টাকার মতো ।বাড়ীতে আমার বুড়ী মা রোগব্যাধিতে ভুগছে । মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে আমার রোজগারের সিংহভাগ খরচা হয়ে যায় । কিম্বা ধরুণ আমি ভিখু । বাগবাজারে আমি রোজ রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে হাতে টানা রিক্সা চালিয়ে দিন আনি দিন খাই । আমার বাড়ীতে আমার বউ আর ছোট ছোট দুটো বাচ্চা একমুঠো ভাতের জন্য আমার মুখ চেয়ে বসে থাকে । বা মনে করুন আমি চামেলি । একটি রেড লাইট এলাকার যৌনকর্মী । কাস্টমারদের শরীর বেচে কোনরকম উচ্ছিষ্ট খেয়ে দিন গুজরান হয় ।হঠাৎ একদিন দেখলাম রাজ্য সরকার করোনা বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ১৪ দিন ব্যাপি কার্ফিউ ঘোষণা করে দিল । কাল বিকেল ৫টা থেকে অকারণে বাইরে বেরনো বন্ধ । বাইরে বেরোলেই লাঠিচার্জ জেল জরিমানা ।যা কাজ করার বাড়ীতে বসে করতে হবে । বাইরে বেরোতে পার কিন্তু শুধু চাল ডাল সব্জী তেল নুন ওষুধ ইত্যাদি কিনতে । তাও আবার পুলিশের চোখরাঙ্গানি ও হুমকি সহ্য করে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা চারজন যারা দিন আনি দিন খাই টাইপ জীবিকার সঙ্গে যুক্ত তারা এই ১৪ দিন খাবোটা কি ? আমরা তো আর আই টি কোম্পানির চাকুরের মতো ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে পারবো না বা মাসের শেষে আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্যালারি সরাসরি ঢুকে যাবে না । আর তাছাড়া আমাদের মতো গরীব মানুষদের বাড়ীতে আপৎকালিন ২০০০০ টাকার মতো জমা থাকা অকল্পনীয় । সুতরাং পেটের তাড়নায় একদিন না একদিন নিজের পরিবারের মুখ চেয়ে তাদের পেটে অন্ন জোগানোর জন্য আমাদের মরিয়া হয়ে বেরোতেই হবে । সে পুলিশের লাঠি খেয়ে যতই মাথা ফাটুক না কেন । বাইরে ওত পেতে আছে করোনার করাল থাবা আর ঘরের মধ্যে খিদের জ্বালায় কাঁদছে আমার বাচ্চাটা । কোন পথটা বেছে নেব আমি একটু বলতে পারেন ? বাড়ীর ভেতরে পরিবার নিয়ে আয়হীন অবস্হায় খিদের জ্বালায় ছটফট করবো আর প্রার্থনা করবো করোনা তাড়াতাড়ি বিদেয় হ ? নাকি বাইরে কাজ খুজতে গিয়ে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিদ্রুপ আর পুলিশি হিংসার শিকার হব ? আর বাইরে কাজ কোথায় ? এই ছোঁয়াছুঁয়ি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাপি আতংকের পরিবেশে কে আমার হাতটানা রিক্সায় চাপবে কেই বা আমার কাছে জুতো সেলাই করতে আসবে আর কোন কাস্টমারই বা আমার ঘরে আসবে নিজের যৌনচাহিদা মেটানোর জন্য । কারণ এখন প্রত্যেকটি মানুষই করোনার বাহক হিসাবে সমান বিপজ্জনক ।


আমি এতো কথা এইজন্য বললাম কারণ আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারছি ভারতবর্ষে আর কয়েক মাসের মধ্যে ঈশ্বর না করুণ একটা ভয়াবহ নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্হা তৈরি হতে চলেছে । একদিকে করোনার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর একদিকে লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের কর্মহীন অবস্থায় মহাদুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা । এই দ্বিমুখী বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গোটা দেশের প্রশাসন ও দেশের সুবিধাভোগী শ্রেণীকে সবার আগে দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর দৈনিক খাদ্য ও ওষুধ যোগানোর ব্যাবস্হা করতেই হবে নইলে ৪৩ বা ৭৬ এর মন্বন্তর ফিরে আসতেই পারে । সঙ্গে তো করোনার মহামারি রয়েছেই । এ ব্যাপারে কি করা যেতে পারে সেটা নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা আছে যা আমি ধাপে ধাপে লিখবো । আপনারাও আপনাদের মতামত দিতে পারেন ।

দীপাঞ্জন দত্ত




Like
Comment

3 comments:

  1. খুব ঠিক কথা বলছিস। আরো cotinue কর।

    ReplyDelete
  2. এটাই সেই বাস্তব যা প্রকট থেকে প্রকটতর হতে চলেছে। এখনও ১৮ দিন, ভাবা যায়! এ তো বিগ বস-এর খেলা নয় যে খাবারদাবার বা তার উপকরণ জুটে যাবে। এরপর অর্থনীতির ভয়ঙ্কর কালো দিনেও আচ্ছে দিনের গ্যাসবেলুন উড়বে।

    লিখে যা। দ্বিতীয় পর্ব পাঠ করার জন্য মুখিয়ে রইলাম।

    ReplyDelete