Thursday 9 August 2018



      ইটালিয়া নাইন্টি : আমার প্রথম বিশ্বকাপ


       আসুন বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে পুরনো কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক আমরা যারা চার বছর অন্তর অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবল টেলিভিশনে দর্শন করে বড় হয়েছি , তাদের কারো কাছে হয়তো বিশ্বকাপের সবথেকে পুরনো স্মৃতি ১৯৮৬, কারো কাছে ১৯৯০ বা ১৯৯৪ বা ১৯৯৮ কেউ হয়তো চলতি শতাব্দীতে জীবনে প্রথমবার বিশ্বকাপের খেলা চাক্ষুষ করেছেন তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়াই যেতে পারে আমাদের দেশে কচিকাচারা মোটিমুটি ১০ কি ১১ বছর বয়স থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাদ নিতে শুরু করে মেসি-রোনাল্ডো-ক্লোজে-রবেনদের ফুটবল ঐতিহ্যশালী দেশগুলিতে জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ দর্শনকারী ক্ষুদেদের এই গড় বয়স হয়তো আরও কম
      এবার নিজের শৈশবের কথায় আসি নিজের স্মৃতিকে টাইম মেশিনে যতোই পিছিয়ে নিয়ে যাই চোখে ভাসে শুধু ইটালিয়া নাইন্টি আজ্ঞে হ্যা ১৯৯০ সাল থেকেই আমি বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা শুরু করি, তাও টুর্নামেন্টের মাঝখান থেকে তখন আমার বয়স মোটে নয় বাবা মা ছোট বোনকে নিয়ে দমদম লিচুবাগানের মোড়ের এক ভাড়া বাড়ীতে ছিল আমার ছোট্ট মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সংসার বাড়ীতে বাবা মায়ের শাসন , বোনের সঙ্গে দিনরাত খুনসুটি আর স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপাটিএইই ছিল আমার জগৎ এমন সময়ে ১৯৯০ এর জুন মাসে রেঁনেসাসের দেশে বসলো বিশ্বকাপ ফুটবলের জমকালো আসর বিশ্বকাপ শুরুর প্রথম প্রথম ফুটবল খেলা কি, খায় না মাথায় দেয় কিছুই বুঝতাম না মনে আছে সম্ভবত ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা চলছিল বাবা পাড়ার কয়েকজন কাকুর সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলেন আমি বারবার বায়না করছিলাম কার্টুন চালানোর জন্য এমন সময় খেলা শেষ হওয়ার নয় মিনিট আগে ব্রাজিলের চারজন ডিফেন্ডারের মধ্যে দিয়ে দিয়েগো মারাদোনার সেই ডিফেন্সচেরা থ্রু সোনালী চুলের ক্যানিজিয়ার উদ্দেশ্যে মুহুর্তের মধ্যে গোওওওওওওওওওওল ঘরভর্তি লোকের চেঁচামিচিতে কান পাতা দায় দশ মিনিট পরে রেফারির বাঁশী চোখের জলে ব্রাজিলের বিদায়



        সেই প্রথম ফুটবলের রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে গেলাম সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম আমার কুয়োর ব্যাঙের জগতের বাইরে আর একটা বিশাল বর্ণময় জগৎ আছেবিশ্বকাপ ফুটবলের জগৎ যা চার বছর অন্তর হাতছানি দিয়ে ডাকে নিজস্ব সৌরভে মাদকতায় মাতিয়ে দিয়ে যায় আপামর বিশ্ববাসীকে এরপর একে একে বিশ্ব ফুটবলের রথী মহারথীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো ম্যাথিউজ,বাস্তেন,রাইকার্ড,গুলিট,ভালদারামা,ক্লিনসম্যান,ব্রেহমে,বুরুচাগা,বুত্রাগুয়েনো,বাজ্জিও,হাজি, স্কিলাচ্চি,দোনাদোনি,বারেসি,মিল্লা,লিনেকার  – কাকে ছেড়ে কার নাম করবো ফুটবল রাজপুত্র দিয়েগো তো আছেনই যে ছেলেটা ম্যাচ চলাকালীন কার্টুন দেখার জন্য বায়না করতো, সেই কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় দিনরাত্রি খেলা গিলতে লাগলো মারাদোনা ম্যাজিক বোধহয় একেই বলে

ক্যামেরুন বনাম কলম্বিয়ার নকআউট রাউন্ডের ম্যাচটা স্পষ্ট মনে পড়ে অতিরিক্ত সময়ে হিগুয়েতাকে কাটিয়ে রজার মিল্লার সেই গোল সাইডলাইনের কাছে গিয়ে কোমর দুলিয়ে সেই নাচ যা পরে কাল্ট হয়ে যায় আমার এক কাজিন নাচটা অসাধারণ নকল করতে পারতো কলম্বিয়াকে হিগুয়েতার ভুলের জন্য খেসারত দিতে হলেও আমার মনে কিন্তু ওর পাগলামো দাগ কেটে গেছিলো ২৮ বছর হয়ে গেলো কিন্তু ওর মতো বর্ণময় চরিত্রের গোলকিপার বিশ্বকাপের আসরে আর দেখতে পেলাম না তবে চুলের ফ্যাশান দিয়ে নজর কেড়ে নিয়েছিলো ভালদারামা মাঠে ভালদারামা বল ধরলেই ঝাকড়া চুল দিয়ে চিনে ফেলতাম ওকে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার একটি ম্যাচে ওদের দুজনকে দর্শকাসনে একসঙ্গে দেখতে পেয়ে ছেলেবেলার স্মৃতি যেন ডানা মেলে উড়ে এল



     আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে দেখতে কেন জানিনা দলটার প্রতি সিমপ্যথি জন্মে গেছিলো প্রতি ম্যাচের আগে প্রার্থনা করতাম দিয়েগোর দল যেন যেতে আর্জেন্টিনা দলটা সে বছর গোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই নড়বড় করছিলো প্রথম রাউন্ডের গন্ডী টায়েটুয়ে পেরিয়েছিলো অনেকটা এবারের বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনার মতো কিন্তু ইংরেজীতে ভারি সুন্দর একটা কথা আছে Women are like the reed, that bends to the breeze but breaks not in the tempest মারাদোনার আর্জেন্টিনা সেবছর ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেও মচকায় নি ব্রাজিল বধের পর কোয়ার্টারে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হলো যুগোস্লাভিয়া তখনও বসনিয়ান জেনোসাইড শুরু হয়ে দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়নি ড্রাগান স্তোইকোভিচের মতো মাঠ কাপানো প্লেয়ার ছিল ওই দলে বুত্রাগুয়েনোর স্পেনকে নকআউটে দুর্দান্ত খেলে হারিয়ে কোয়ার্টারে উঠেছিল ইউরোপের ব্রাজিল বলে খ্যাত যুগোস্লাভ দলটা ধারে ভারে আর্জেন্টিনার থেকে বেশ এগিয়ে ছিল এই দলটা
        খেলা শুরু হল প্রথম হাফটা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবে গোলশূন্য শেষ হল হাফটাইমের পরে যুগোশ্লাভিয়া অসাধারণ খেলতে লাগলো কোনরকমে আর্জেন্টিনা বিপক্ষের আক্রমণ সামাল দিতে লাগলো অসাধারণ সেভ করতে লাগলেন আর্জেন্টাইন গোলকিপার গোয়কোচিয়া যিনি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে নেরি পম্পিদুর পরিবর্ত হিসাবে মাঠে নেমেছিলেন ৯০ আর্জেন্টিনা দলের তিনজন খেলোয়ারের স্মৃতি আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে মারাদোনা, ক্যানিজিয়া গোয়কোচিয়া তো যা বলছিলাম মারাদোনাকে বোতলবন্দী করে যুগোশ্লাভিয়া ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়েও গোল করতে পারলো না অতিরিক্ত সময়ে গোলশূন্য থাকার পর ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে সেটাই আমার দেখা প্রথম টাইব্রেকার এবং সেখানেই প্রথম দেখলাম ফুটবলের ঈশ্বরও পেনাল্টি মিস্ করেন ম্যাচ যখন টানটান অবস্থায় সেই সময় মারাদোনা শট নিতে এলেন বাচ্চাদের মতো গড়ানো শট মেরে বল গোলকিপারের হাতে তুলে দিলেন কি হতাশ যে হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না বাজ্জিও,গ্যাসকোয়েন,মেসি থেকে রোনাল্ডোজীবনে বহু বহু সুপারস্টারের পেনাল্টি মিস্ দেখেছি কিন্তু মারাদোনার কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো পেনাল্টি মিস্ যে অবিশ্বাস্য ! গতকালই youtube সেই টাইব্রেকারের ভিডিও দেখছিলাম সে যাত্রা আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছিল গোয়কোচিয়ার সোনার হাত একা হাতে দলকে নিশ্চিত হারের হাত থেকে বাঁচিয়ে সেমিফাইনালে তুললো সে মারাদোনা ক্যানিজিয়ার পাশাপাশি আমার হৃদয়ে স্থান করে নিল গোয়কোচিয়া



আর্জেন্টিনাইতালি সেমিফাইনাল ম্যাচ টিভিতে দেখাও একটা অভিজ্ঞতা ছিল বটে ৯০ ইতালির ডিফেন্সের মত শক্তিশালী ডিফেন্স আমি পরবর্তী কালে আর দেখিনি মালদিনি -বারেসি- দোনাদোনিভিয়ালি এই চার দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলার বিশ্বকাপে ইতালির ডিফেন্সে একটা মাছিও গলতে দেয়নি স্বয়ং ভগবানকেও বোধহয় এদের কাছে অনুমতি নিতে হত ইতালির পেনাল্টি বক্সে ঢোকার জন্য গোল করা তো বহুৎ দূর কি বাত্ তা এরকম একটা দলের মুখেই সেমিতে তাদের হোম গ্রাউন্ডে পড়ে গেল বিশ্বকাপে টিমটিম করে টিকে থাকা মারাদোনার আর্জেন্টিনা যতদূর মনে পড়ে ম্যাচটা শুরু হয়েছিল রাত টায় ম্যাচের শুরুতেই টোটো স্কিলাচ্চি গোল করে ইতালিকে এগিয়ে দিয়েছিল আর্জেন্টিনা চেষ্টা করছিল বটে ইতালির ডিফেন্সে ছিদ্র খোঁজার কিন্তু কোন দলই দৃষ্টিনন্দন খেলা খেলছিল না এমন সময় লোডশেডিং হয়ে গেল বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ম্যাচ কারেন্ট চলে গিয়ে অন্ধকারে চাতক পাখির মতো বসে আছি কখন আবার কারেন্ট আসবে তখনকার যুগে কারেন্ট চলে গেলেও মোবাইল অ্যাপস্ খেলা দেখা অকল্পনীয় ছিল কারেন্ট এল প্রায় এক ঘন্টা পরে তড়িঘড়ি করে টিভি চালিয়েই দেখি রেজাল্ট - খেলার শেষ ভাগে দুর্ভেদ্য ইতালিয়ান ডিফেন্সকে টপকে গোল শোধ করেছে সেই ক্যানিজিয়া ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম রেফারির বাঁশি বাজতেই ম্যাচ গড়ালো এক্সট্রা টাইম শেষমেশ সেই টাইব্রেকারে এবার কিন্তু মারাদোনা পেনাল্টি মারতে কোন ভুল করলেন না অন্যদিকে গোয়কোচিয়া দুটো অনবদ্য সেভ করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তুললেন আর্জেন্টিনা জিতে যাওয়ার পর আমার সেকি চিৎকার  !!!!


      তারপর এল জুলাই এর সেই অভিশপ্ত ফাইনাল ম্যাচ আর্জেন্টিনা বনাম পশ্চিম জার্মানি মারাদোনা বনাম ম্যাথিউজ জুলাই মাসেই আমার বাবা কলকাতা থেকে বদলি হয়ে বহরমপুরে চলে গেলেন আমাদের সবাইকে নিয়ে বহরমপুরের ভাড়া বাড়ীতেই ফাইনাল ম্যাচটা দেখেছিলাম তখনও বাক্স প্যাটরা খুলে আসবাবপত্র সাজিয়ে হয়ে ওঠা হয়নি যেদিন সকালে বহরমপুর পৌঁছলাম সেদিন রাত সাড়ে টা থেকেই রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে সরাসরি টিভিতে ম্যাচ সম্প্রচার হওয়ার কথা তাই বাবা লোক ডেকে টিভির ব্যবস্থাটা আগে ভাগে করে রাখলেন রাতের খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে ম্যাচ দেখতে বসলাম মন চাইছে দিয়েগোর হাতে বিশ্বকাপটা উঠুক,কিন্তু যুক্তি বলছে জার্মানি ৮৬ ফাইনালের বদলা নেবেই খেলার প্রথম মিনিট থেকেই জার্মানি বুঝিয়ে দিল কাপ জিততে তারা কতটা বদ্ধপরিকর ব্লিৎজক্রিগ্ বলে জার্মান ভাষায় একটা শব্দের জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর অর্থ হল ঝঞ্ছার বেগে আক্রমণ যা শত্রুকে হতভম্ব করে দেবে জার্মান ফরোয়ার্ডরা ঢেউয়ের মতো উঠে আর্জেন্টিনার গোলে আছড়ে পড়তে লাগলো বার দুয়েক আর্জেন্টিনার পোস্টে বল লাগলো বারকয়েক বল গোলপোস্টের গা ঘেষে বেরিয়ে গেল আপনারা যারা ৯০ ফাইনাল দেখেন নি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না জার্মানি কিভাবে দুরন্ত গতিতে আক্রমণ শানিয়ে গেছে এবং এটা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয় আর্জেন্টিনা কিভাবে ম্যাচের প্রায় ৮০ মিনিট পর্যন্ত অভিমন্যুর মতো বুক চিতিয়ে জার্মানিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল আর্জেন্টিনার দেজট্টি মনজনকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে বের করে দেন মেক্সিকান রেফারি এডগার্ডো মেনডেজ এখনও যেন চোখের সামনে ভাসে দুজনকে লাল কার্ড দেখানোর পর মারাদোনার রেফারির সঙ্গে তর্কাতর্কির দৃশ্য জনে মিলে লড়াই করে কতক্ষণই আর জার্মানদের ঠেকিয়ে রাখা যায় ম্যাচের ৮৫ মিনিটের মাথায় জার্মানিকে দেওয়া হলো সেই বহু বিতর্কিত পেনাল্টি যেটা নিয়ে আজও জার্মানি আর্জেন্টিনার ফ্যানদের মধ্যে রেষারেষি চলে রবার্তো সেনসিনি পেনাল্টি বক্সের ভেতরে রুডি ফোয়েলারকে ফাউল করেন আমার সেনসিনির অ্যাকশন দেখে মনে হয় তখনকার যুগে যদি VAR থাকতো তাহলে হয়তো জার্মানি পেনাল্টিটা নাও পেতে পারতো বা ৫০-৫০ সুযোগ থাকত পেনাল্টি পাওয়া বা না পাওয়ার মধ্যে এখনও ফাউলের ভিডিও দেখে মনে হয় সেনসিনি ফোয়েলারকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ট্যাকল করেননি, ফোয়েলারের পায়ের সামনে থেকে বলটা ক্লিয়ার করতে গেছিলেন মাত্র

     যাই হোক আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক গোয়কোচিয়া যখন গোলপোস্টের নিচে দাঁড়ালেন বুক থেকে হৃৎপিন্ডটা যেন খুলে আসার যোগাড় হল মাথার শিরা টনটন করতে লাগলো পারবে তো গোয়কোচিয়া তার সোনার হাত দিয়ে আর্জেন্টিনাকে আরও একবার রক্ষা করতে ? পারবে তো রেফারির মুখের উপর যোগ্য জবাব দিতে ? কিন্তু হাসেন অন্তর্যামী ঠান্ডা মাথায় ব্রেহমে পেনাল্টি থেকে গোল করে জার্মানিকে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন এই ম্যাচের ঠিক ২০ বছর পরে দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে ব্রেহমের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখন পেনাল্টি শটটা আবার মারার সুযোগ পেলে কি গোল করতে পারতেন ? মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন এখন হয়তো শটটা বাইরে চলে যেত - হয়ে যাওয়ার পর শেষের মিনিট ছিল শুধুই নিয়মরক্ষার খেলা জনে খেলে জার্মান শেলে বিধ্বস্ত আর্জেন্টিনার পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না জার্মান অধিনায়কের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি ওঠা তখন কেবল কিছু সময়ের অপেক্ষা

      শেষমেশ ম্যাচ শেষের বাঁশী বাজল মারাদোনার চোখ থেকে ঝরঝর করে জলের ধারা নেমে এল যেন যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে হেরে যাওয়া আহত রক্তাক্ত অপমানিত এক মিলিটারি জেনারেল যার কাছে ব্যর্থতার চেয়ে বড় ব্যর্থতা কিছু হতে পারে না এখনও মনে আছে টিভির পর্দায় স্টেডিয়াম ছাপিয়ে রোমের আকাশে ঈষৎ মেঘে ঢাকা চাঁদ দেখা যাচ্ছিল উপরে চন্দ্রালোকিত আসমান তো নিচে বিশ্ব ফুটবলের আমার দেখা সর্বকালের সর্বসেরা ট্রাজিক দৃশ্য রাজপুত্রের চোখে বিষাদের জল বিশ্বকাপ অনেককে দুহাত ভরে ভরিয়ে দিয়েছে , অনেককে আবার করেছে পথের ভিখারী বিশ্বকাপের আসরে বহু সুপারস্টারকে ব্যর্থ হয়ে কাঁদতে দেখেছি কিন্তু মারাদোনার কান্না সেদিন এই বছরের বালকের কাছে শুধু কান্না ছিল না , ছিল বুক ফেটে বেরিয়ে আসা এক আর্তনাদ সেদিন আমিও আর নিজের কান্না ধরে রাখতে পারিনি কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম বাবার চোখের কোনাটাও যেন চিকচিক করছে সেদিন চোখের সামনে রচিত হতে দেখলাম বিশ্ব ফুটবলের এক ট্র্যাজিক মহাকাব্য


তারপর দীর্ঘ ২৮ বৎসর কোথা দিয়ে হু হু করে পেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল আরও ছয় ছয়টা ফুটবল বিশ্বকাপ বিশ্বকাপ ফুটবলের রণাঙ্গনে কত তারকা মহাতারকার উথ্থান পতনের সাক্ষী রইলাম আজ সেই বছরের বাচ্চা ছেলেটা ৩৭ বছরের মধ্যবয়স্ক সংসারী মানুষ কিন্তু আজও ইটালিয়া নাইন্টির বিষাদমধুর স্মৃতি আমার মানসপটে জাগরুক হয়ে আছে প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের গর্ব করে বলতে ইচ্ছা করে আমি টিভিতে ফুটবলের ঈশ্বরকে খেলতে দেখেছি দেখেছি আফ্রিকার সিংহ রজার মিল্লাকে দেখেছি ডিফেন্সের সম্রাট মালদিনিকে তার সেরা ফর্মে দেখেছি বাস্তেনরাইকার্ড-গুলিট নামক তিন মাথাওয়ালা ফুটবল ত্রাসকে দেখেছি গ্যাসকোয়েনের কান্না দেখেছি ফাইনালে জয়সূচক গোলের পর ব্রেহমেকে ঘিরে জার্মানদের জয়োল্লাস সর্বোপরি দেখেছি রাজপুত্রের বুকফাটা কান্না জীবনে আরও হয়তো ১০ টা বিশ্বকাপ দেখে যেতে পারব বিশ্ব ফুটবলের বহুমুখী বিবর্তনের সাক্ষী হব কিন্তু ইটালিয়া নাইন্টি আমার কাছে বরাবরই একটা মহাযুগ হয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে

2 comments: